Campus university students Crime

শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কৃতদাসের মতো ব্যবহার করা হয়

ক্যাম্পাস

এলাকার নম্র-ভদ্র আর তুখোড় মেধাবী ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। অথচ অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা এই ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাতারাতি মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী আর চাঁদাবাজ হয়ে যায়! একটা সম্ভাবনাময় মেধাবী ছেলেকে অপরাধী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অপসংস্কৃতির দায় সব চেয়ে বেশি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল প্রশাসনে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা কি এই দায় এড়াতে পারবে?

শিক্ষকরা হলগুলো ছাত্রলীগের কাছে ইজারা দিয়ে রাখছে; আর ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কৃতদাসের মতো ব্যবহার করছে।

আমাদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করেননি। এক শ্রেণির শিক্ষক পদ-পদবীর লোভে আমাদেরকে ছাত্রলীগের হাতে তুলে দিয়েছে। আরেক শ্রেণির শিক্ষক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নির্বিকার থেকে এহেন অন্যায়-অবিচারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারাও দায়িত্বশীল আচরণ করেনি।

দায়িত্বশীল শিক্ষকদের এই নীরবতা অত্যাচারীকে আরো হিস্র হতে সাহায্য করেছে। জাতির বিবেকরা নিজেদের বিবেক দ্বারা তাড়িত না হয়ে ছাত্রলীগ দ্বারা তাড়িত হচ্ছেন। এতে করে শিক্ষার্থীদের জীবনকে যেমনিভাবে বিপন্ন করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে তারা নিজেরাও একটা ব্যক্তিত্বহীন, নতজানু জীবনের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন।  বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অপসংস্কৃতি চালু করেছেন।

দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা অনেক শিক্ষার্থীর ঢাবি’তে চান্স পাওয়া যেনো একটা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়! তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ছাত্রলীগ একটা সিটের বিনিময়ে তাদেরকে নিজেদের কেনা গোলামের মতো ব্যবহার করতেছে৷ ছোট্ট একটা গণরুমে ৩০-৪০ একসাথে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।

ক্লাস-পড়াশোনা বাদ দিয়ে, রোধ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারাদিন সরকার দলীয় নেতাদের প্রটোকল আর মিছিল-মিটিং করা লাগে। রাত হলে গেস্ট রুম। গ্রাম থেকে উঠে আসা আলাভোলা ছেলেটার কাছে এই গেস্টরুম এক আতঙ্কের নাম। গেস্ট রুমের অনবরত শারিরীক-মানসিক নির্যাতন, আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

গেস্ট রুম শেষে আবার সিনিয়র ভাইদের কড়া আদেশ পালন করতে হয়- রাত দুইটা – তিনটা পর্যন্ত বাধ্যতামূলক হলের বাহিরে থাকতে হয়।

সারাদিন খেয়ে না খেয়ে প্রোগ্রাম – গেস্টরুম করে মানসিকভাবে অস্থিতিশীল এই ছেলে গুলোর মধ্যে কেউ কেউ একটু প্রশান্তির খোঁজে অন্যায় জগতে পা বাড়ায়। তার উপর ভাইদের দেওয়া সার্টিফিকেট – ❝তোরা ফাস্টিয়ার, ক্যাম্পাসে তোদের সাত খুন মাফ। নারী কেলেঙ্কারি বাদে বাকি সব জায়গায় ভাইদেরকে পাশে পাবি।❞

ভাইরা নিজেদের স্বার্থে এমন উৎসাহ দেয়, আর অনেকেই বয়সের তাড়নায় সেটার পূর্ণ ব্যবহার করে!

রাতে হল থেকে বের করে দেওয়া ছেলেপেলের মধ্যে মাদককেন্দ্রিক একটা সার্কেল গড়ে উঠে, একাধিক হলের সমমনা ছেলেরা এই সার্কেলে যুক্ত হয়। এরা উদ্যানে যায়, মাদক নেয়, মাদকের টাকা জোগাড় করতে ক্যাম্পাসে ছিনতাই করে, যানবাহন আটকিয়ে চাঁদা নেয়। বড় ভাইদের মাদক ব্যবসার সাথেও এরা জড়িয়ে পড়ে।

ক্ষেত্র বিশেষ এরা ধরা পড়ে, নেতারা পাওয়ার খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা থানা-হাজত  থেকে এদেরকে ছাড়িয়ে আনে। মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এদের দুই-একজনকে হল থেকে বহিষ্কার করে। তারপরেও তারা নেতার শেল্টারে হলে থাকে, ক্যাম্পাসে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। আগের চেয়ে অধিকতর আগ্রাসী হয়ে ফিরে আসে, নবোদ্যমে দাপুটের সাথে অপরাধ করে বেড়ায়।

এদেরকে দিয়ে নেতারা আবার নিজেদের বিশেষ বিশেষ স্বার্থ হাসিল করে। মাদকের ব্যবসা করায়, ক্যাম্পাসে ভিন্নমত দমনে এদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে এরাই আবার গেস্টরুমে এ্যাগ্রেসীভ থাকে, জুনিয়দেরকে মারধর করে।

এভাবেই অজপাড়া গাঁয়ের এক সুবোধ বালক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতার বলি হয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি হয়ে যায়। পরিবেশ – পরিস্থিতি তাকে মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী আর চাঁদাবাজে রূপান্তরিত করে। এমনি করে, “প্রলয়” আসে, সব স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়!

লেখক: আব্দুল কাদের
শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়