স্বাধীনতা মানুষের অনন্ত পিপাসা। অবলা প্রাণী থেকে শুরু করে পৃথিবীর উন্নত প্রতিটি জীবেরই এই পিপাসা বিদ্যমান। কিন্তু জীবভেদে, কালভেদে, স্থানভেদে এই “স্বাধীনতা” শব্দটি ভিন্ন অর্থ বহন করে।
শাব্দিক অর্থে স্বাধীনতা বলতে মুক্ত-বিহঙ্গ বোঝালেও এর ভাবার্থের গভীরতা অনেক। স্বাধীনতা একটি গানের সুর, তাল বা লয় যা বিমোহিত করে হাজারো ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নকে, জাগিয়ে তোলে হাড্ডিসার বৃদ্ধের তপ্ত হৃদয়কে। যে স্বপ্ন সাকিনা বিবির সিঁদূর মুছে দেওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়, হরিদাসীর পতী-বিয়োগের যন্ত্রণা দূর করে দেয় সেই স্বাপ্নিক শব্দকেই বলে স্বাধীনতা।
আমি সেই স্বাধীনতার চেতনায় বিভোর যে স্বাধীনতা মানে শুধু লাল সবুজ শাড়ি পরে শহীদ মিনারে পুষ্পার্পনকে বোঝায় না সেই স্বাধীনতা মানে শুধুই পতাকা উত্তোলন বা ক্লাবে ক্লাবে আবেগ- আপ্লুত গান গাওয়া নয়।
বিজয়ের সূবর্ণ জয়ন্তীতে ৭১ এর স্বাধীনতার সেই রক্তিম সূর্য না দেখা এই আমার কাছে স্বাধীনতা বলতে বোঝায়-
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র তোরণের পাশের ফুটপাতে শুয়ে থাকা ঐ অবুঝ শিশুটির মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন। এ প্রসঙ্গে একটু বলি। ভীষণ-২১ এর একটি উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বলবে।পেপার পত্রিকায় এসব নিয়ে হাজারো রচনাও রচিত হয়। ঠিক এই সময়ে আমার মনে পড়ে যায়, তাবির মাহমুদের গানের সেই বিখ্যাত লাইনগুলো -“শিক্ষার আলো নাকি ঘরে ঘরে জ্বলবে! আমাদের ঘর নাই সেকথা কে বলবে?” আর তাই আজ আমার কাছে স্বাধীনতা মানে রানা রাজুর মতো পথশিশুদের শিক্ষার আলো জ্বালবার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা।
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে স্নাতক পাশ দেওয়া বেকার ছেলেটির জন্য ঘুষবিহীন চাকরির অধিকার বাস্তবায়ন করা।
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে শাহবাগ মোড়ে গলা উচিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পরও আমার জীবনের নিরাপত্তা।
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করে হাজারো আলোকে জ্বেলে উঠার সুযোগ করে দেওয়া।
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে কৃষকের ফলানো ফসলের নায্য মজুরি পাওয়ার অধিকার।
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নুসরাত, সাইমা, আসমার মতো হাজারো নারীর ধর্ষণের সুবিচার ও ধর্ষণ প্রতিরোধ নিশ্চিত করা!
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে গণরুমে এককাত হয়ে শুয়ে থাকা ঐ ছেলেমেয়েগুলোর শান্তি নিশ্চিত করা এবং এই প্রবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করা- “চীনের দুঃখ হোয়াংহো, ঢাবির দুঃখ গণরুম।”
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও এসব লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেওয়া যেখানে প্রতিনিয়ত হাজারো নারীকে পান থেকে চুন খসলেই শুনতে হয়, “বাপের বাড়িত্তে কি ছায়ডা আনছোস?”
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে, লোকাল বাসে পুরুষের শক্ত হাতের চাপ থেকে নারীর অঙ্গগুলো রক্ষা পাওয়া।
- আমার কাছে স্বাধীনতা মানে, পূর্ণবয়স্ক প্রতিটি মানুষের ভোটাধিকার নির্বিঘ্নে নিশ্চিত করা।
অন্য কথায় আসি, ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের একটি লাইন ছিলো –
“বাংলাদেশের জনগনের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিত করা। “
আমরা বর্তমান যুগের তরুণরা ৭১ দেখিনি, আমরা ৭ই মার্চের ভাষণ সরাসরি শুনিনি কিংবা ১০ই এপ্রিলের উপর্যুক্ত লাইনটির স্বাক্ষী হয়ে থাকিনি। তাই আমাদের কাছে স্বাধীনতা মানে শুধু কথা বলার স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ স্মৃতিচারণ নয় বরং স্বাধীনতা শব্দটির একই বৈচিত্র্য নিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি একটি সোনার বাংলার, যে বাংলায় নিশ্চিত হবে –
-প্রতিটি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকার।
-হতাশার শৃঙ্খল ছিঁড়ে লাল নীল স্বপ্ন।
যেদিন রুপকথার মতো এই বাংলা থেকে দেশী বিদেশি ষড়যন্ত্রের তৎপরতা রোধ হবে, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুব সমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জলস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, দূর্নীতি ইত্যাদির মতো সকল অনাচার দূর হবে সেদিনই আমি চিৎকার করে বলবো- “আজ আমি স্বাধীনতা পেয়েছি।”
১৯৭১ সালে আমরা যে কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা একটি বর্ণালী অধ্যায়। আমাদের আনন্দ-বেদনার স্বর্ণালী পদ্ম।আমাদের জাতীয় চেতনার এই দীপালি অধ্যায় জ্বালিয়ে গিয়েছিল প্রেরণার অগ্নিমশাল। সেই অগ্নিমশালের তেজে কি আমার কাছে স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় সেগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব?’
কোন কিছুই অসম্ভব নয়। কারণ, “আলোক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জাগেনা, স্রোত ব্যতীত যেমন নদী টেকে না, স্বাধীনতা ব্যতীত তেমন জাতি টিকতে পারেনা।”
তানভীরা অনু
শিক্ষার্থী, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়