Bus Launch Corona situation

বাসে-লঞ্চে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গণপরিবহনের জন্য দেওয়া নির্দেশনার কিছুই মানা হচ্ছে না। চালক, হেল্পার ও কন্ডাক্টররা যেমন খুশি তেমনভাবেই যাত্রী বহন করছে। নিষেধ থাকলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। নেই কোনো সতর্কতা, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা। বেশিরভাগ পরিবহন শ্রমিকরা মুখে সঠিকভাবে মাস্ক পরছে না। কারও মুখে মাস্ক থাকলেও তা থুঁতনিতে রাখা। ছিল না করোনার টিকা নেওয়ার কোনো সনদ। ওদিকে লঞ্চেও একই অবস্থা। তবে ট্রেন চলেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। সরকার নির্দেশনা দিয়েছিল অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চালাতে হবে।

কিন্তু বাসমালিক সমিতির নেতারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে বৈঠকে বসে এই শর্ত শিথিল করার অনুরোধ জানান। পরে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মৌখিকভাবে মালিকদের জানিয়েছেন সব আসনে যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে বাসমালিকদের অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মালিক সমিতির নেতারাও অন্য মালিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সে নির্দেশনাও মানতে দেখা যাচ্ছে না।

রাজধানীর আসাদগেট, ফার্মগেট, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার ও সদরঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন দেখা গেছে, শ্রমিকরা মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। অনেকের মুখে নেই মাস্ক। কারও থাকলেও তা থুঁতনিতে রেখে দিয়েছে। যাত্রীদের প্রতিও তাদের খেয়াল নেই। কেউ মাস্ক না পরা থাকলেও সে অবস্থায়ই তাকে বাসে তোলা হচ্ছে। আসন ফাঁকা না থাকার পরও রাস্তায় যাত্রী পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাস থামিয়ে যাত্রী তুলছে। এসব পরিবহনের মধ্যে অন্যতম হলো- বিকাশ পরিবহন, সাভার পরিবহন, শিকড়, এসএম লাভলি, আয়াত, তানজিল, বসুমতি, স্বাধীন এক্সপ্রেস, মিরপুর মেট্রো সার্ভিস, ঠিকানা, ট্রান্সসিলভা, মৌমিতা, বাহন, স্বজন, সৌদিয়া, আলিফ, ওয়েলকাম, অগ্রদূত, দিশারী, নিউ ভিশন ও হিমাচল পরিবহন।

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের সিগন্যালে মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের একটি বাস থামান দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ। এ সময় দেখা যায় গাড়িটিতে ১২ থেকে ১৫ জন দাঁড়ানো যাত্রী রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চলাচল করে মৌমিতা পরিবহনের এই বাস। চালকের মুখে ছিল না মাস্ক। দাঁড়িয়ে যাত্রী নিয়েছেন কেন? সাব্বির নামে ওই চালককে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘উঠছে কী করুম। উঠলে কী করমু। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া যাবে নাÑ এ বিষয়ে কিছু জানি না আমরা।’

করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়া আছে কি না জিজ্ঞেস করলে বলেন, নেই নাই। এ সময় তাদের সব কাগজ ঠিক থাকায় বাসটি ছেড়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু যাত্রী দাঁড়ানো থাকার পরও তাদের কিছুই বলা হলো না।

আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের ওই এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, ‘আজকে তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। অনেককেই বলে দিচ্ছি যে, দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া যাবে না। আর আমাদের ঊর্ধ্বতন

কর্মকর্তারা সামনে আমাদের কোনো নির্দেশনা দিলে সেভাবে কাজ করব।’
স্বাস্থ্যবিধি না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সময়ের আলোকে বলেন, ‘যারা নির্দেশনা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে বিআরটিএ অভিযান চালাচ্ছে। তাদের ধরার জন্য আমাদের টিমও কাজ করছে।’

অন্যদিকে বিআরটিএ’র এনফোর্সমেন্ট বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর হেমায়েতউদ্দিন জানিয়েছেন, ‘নিয়ম না মানায় শনিবার তাদের ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এতে ১৮২টি বাসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মামলা দেওয়া হয়েছে ৪২টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা।

অনেক যাত্রী মাস্ক পরলেও অনেকের ক্ষেত্রেই উদাসীনতা দেখা গেছে। কেউ মাস্ক পরেনি, কেউবা মাস্ক রেখেছে থুঁতনিতে। 
সুমন আহমেদ নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় এসেছেন। পড়েন শহরের সিটি কলেজে। কারওয়ান বাজার মোড়ে তিনি মিরপুর যাওয়ার বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মুখে মাস্ক নেই কেন- জানতে চাইলে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘পড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। অনেকেই তো মাস্ক পরেননি। তাই আমিও পরিনি। আল্লাহ ভরসা।’

লঞ্চেও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা নেই : সব নৌযানের চলাচলের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা, সক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী নিতে হবে। মালিকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন সক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী নেবেন। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে। কিন্তু শনিবার সদরঘাট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউ। অধিকাংশ লঞ্চের স্টাফ, ম্যানেজারের মুখে মাস্ক নেই, কেউ কেউ মাস্ক লাগালেও তা রেখে দিয়েছে থুঁতনির নিচে। যাত্রীদের সতর্ক করছে না কেউ। যে কারণে যাত্রীরাও মাস্ক পরতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীন। ঢাকা নদীবন্দর থেকে প্রতিদিন ৪৫টি রুটে কয়েকশ’ লঞ্চ ছেড়ে যায়। আবার গন্তব্য থেকে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসে এ ঘাটে। এসব লঞ্চের মধ্যে দুয়েকটিতে স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশেরই ছিল না। সামাজিক দূরত্ব না মেনে যাত্রীরা লঞ্চের ডেকে গাদাগাদি করে শুয়ে-বসে রয়েছে। অধিকাংশ লঞ্চের ম্যানেজার ও স্টাফদের কাছে নেই করোনা টিকার সনদ। বিআইডব্লিউটিএ থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার কোনো টিমও দেখা যায়নি।

ভোলাগামী যাত্রী নোমান পাটোয়ারী সময়ের আলোকে বলেন, লঞ্চ কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যবিধির নিয়ে কোনো মাইকিং বা সতর্ক করেনি। আমরা স্বেচ্ছায় মাস্ক পরছি।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদিন সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমরা সকালে লঞ্চগুলোর চালক-মালিকদের কাছে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বলে দিয়েছি। যাদের মাস্ক ছিল না তাদেরও মাস্ক পরিয়ে দিয়েছি। রোববার মন্ত্রণালয় থেকে একটি সার্কুলার আসার কথা রয়েছে। সার্কুলার পেলে আমরা সেভাবে কাজ করব।

নিয়ম মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলছে ট্রেন : করোনা সংক্রমণে নতুন করে আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে শনিবার থেকে আবারও অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে চলাচল করছে ট্রেন। তবে কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়া অন্যান্য স্টেশনে লোকাল ট্রেনগুলোতে এ নিয়ম পুরোপুরি মানা হয়নি। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর গত সোমবার বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর পরদিন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, যা গতকাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

অন্যদিকে তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, টঙ্গী ও জয়দেবপুর স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে অর্ধেক আসনের নিয়ম মানা হয়নি। বিশেষ করে শনিবার বিকালে জামালপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া কমিউটার ট্রেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখা হয়নি। তা ছাড়া বিভিন্ন মেইল ও কমিউটার ট্রেনগুলো কমলাপুর থেকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ছেড়ে এলেও অন্যান্য স্টেশনে এসে তা পূর্ণ হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকায় কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে যেভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে, সেখানে কেউ চাইলে টিকেট ছাড়া ঢুকতে পারবে না। কিন্তু অন্য স্টেশনগুলোর প্রায় চারপাশই ফাঁকা। ফলে লোকাল ট্রেনগুলো থামলে যাত্রীরা এসে ভিড় করে। নিরাপত্তারক্ষীরাও তাদের আটকে রাখতে পারে না। চারপাশের খোলা জায়গা দিয়ে টিকেট ছাড়া অনেক যাত্রীও ট্রেনে উঠে পড়ে। 

তবে বাস ও লঞ্চের চেয়ে ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা গেছে। লোকাল ট্রেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার নিয়ম পুরোপুরি না মানলেও আগের মতো গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হয়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, মাস্ক ছাড়া কাউকে টিকেট দেওয়া হয়নি। টিকেট থাকার পরও মাস্ক না থাকলে কাউকে স্টেশনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে কমলাপুর স্টেশনে শনিবার সকাল থেকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া একাধিক আন্তঃনগর ও লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের আসন ফাঁকা রেখে বসতে দেখা গেছে। তবে পরিচিত যাত্রীদের কেউ কেউ ট্রেনে উঠে পাশাপাশি বসেছে। এ সময় মাস্ক না থাকায় স্টেশনের গেট থেকে অনেককেই ফিরিয়ে দিতে দেখা গেছে। করোনা সংক্রমণ রোধে আরও বেশকিছু পদক্ষেপ চোখে পড়েছে।

এর মধ্যে কমলাপুর স্টেশনের প্রবেশপথেই একটি বোতলে জীবাণুনাশক রাখা হয়েছে। পাশেই তা ব্যবহার করার একটি নির্দেশনা টানানো আছে। তা ছাড়া স্টেশনে যাত্রীদের বসার তিন আসনের বেঞ্চগুলোতে মাঝের আসন ফাঁকা রেখে বসার নির্দেশ দিয়ে স্টিকার লাগানো হয়েছে। বিধিনিষেধের প্রথম দিন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের এমন ব্যবস্থাপনায় যাত্রীরাও সন্তুষ্ট। তবে অনলাইনে ও কাউন্টারে টিকেট না পেয়ে অনেকেই ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনের ধারণক্ষমতার অর্ধেক আসনের টিকেট অনলাইন ও কাউন্টার দুই জায়গায় সমানভাবে বিক্রি করা হয়েছে। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ টিকেট বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে (অ্যাপ/ওয়েবসাইট)। আর বাকি ৫০ শতাংশ টিকেট স্টেশনের কাউন্টারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ জন্য কোনো ভাড়া বাড়ানো হয়নি।

কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার বলেন, সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ট্রেনে যাত্রা শুরু ও শেষে জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে। সকাল থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ১২টি আন্তঃনগর ও ৬টি লোকাল ট্রেনেও প্রতিটি অর্ধেক আসনের যাত্রী নিয়ে ছেড়ে গেছে। কোনো স্ট্যান্ডিং টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে না।