‘আকাশে বহিছে প্রেম/ নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে…।’ হাড় কাঁপানো শীতের দাপট ইতোমধ্যে অনেকটাই কমে গেছে। গাছের কচি পাতাগুলোর গা ছুঁয়ে মেখেছে নানা রঙ। রক্তিম রঙে সেজেছে কৃষ্ণচূড়া-শিমুল। ইট-পাথরের এই ঢাকায় গুনগুনানির তালে কোকিলের কুহু কুহু ডাক যেন সোনার হরিণ, তবুও তা কানে ভেসে আসে। এ যেন প্রকৃতিজুড়ে এক উৎসবের আমেজ। শীতের খোলস ছেড়ে দখিনা হাওয়া, মৌমাছিদের গুঞ্জন, কচি-কিশলয় আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন আজ- ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…।’ আজ সোমবার বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুন। চলুন এবার জেনে নিই বসন্ত উদযাপনের ইতিহাস।
জবুথবু শীতের রিক্ততা ভুলে মনে-প্রাণে, ঘরে-বাইরে, পত্রপল্লবে বেশ সরবেই জানান দিচ্ছে ‘আমি এসেছি’। ভালোবাসতে, তোমাকে আলিঙ্গন করতে। খুব নীরবে যে কথা বলতে পারোনি, সে কথাই আজ শোনার জন্য এসেছি।
না সে আর অন্য কেউ নয়, সে ‘ঋতুরাজ বসন্ত’। খুব অভিমানে বছরজুড়ে না বলা গল্পের দিন আজ। একসঙ্গে নতুন প্রকৃতিতে শ্বাস নেওয়ার দিন আজ। কবির ভাষায়, ‘সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে…।’
রাজধানীর শাহবাগের ফুলের দোকানের পসরা, বেইলি রোডের গাছগাছালি, রমনা, ধানমন্ডি, চন্দ্রিমা উদ্যানের সারি সারি গাছ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা চত্বর, ধানমন্ডি লেকে শির সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোতে সতেজতা ফিরেছে। নতুন রঙ, নতুন দিনে জীবনকে রাঙাতে তরুণ-তরুণীরাও বের হচ্ছে শাড়ি-পাঞ্জাবিতে।
বাসন্তী রঙের শাড়ি আর মাথায় হলুদ ফুল দিয়ে নিজেদের সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত তরুণী আর তরুণদের পরনে হলুদ রঙের বাহারি পাঞ্জাবি। ফুল, ঘড়ি, কার্ড, চকলেট ও উপহার বিনিময়ের রীতি অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও চলবে। নীরবে-নিভৃতে কেউ প্রিয়জনকে একপলক দেখে আসবে।
দীর্ঘদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে এলেও বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের পর এখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনের প্রথম দিন বসন্তের আগমন। প্রতিবছর এ দিনকে বরণ করতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ। তবে এবার সীমিত আকারে হবে সেই উদযাপন।
সীমিত আকারে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চে বসন্ত উৎসব হবে। আগে একসঙ্গে ঢাকার উত্তরা, বাহাদুর শাহপার্ক ও রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠান করা হতো। এবার কোনোটিই হবে না।
বসন্তের বন্দনা করে একটি বাক্যও লেখেননি, এমন বাঙালি কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে বলেছেন, ‘কোরো না বিড়ম্বিত তারে। তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিও। দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে। আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।’
ভানুসিংহ ঠাকুরের উতলা চিত্তের আকুলতা এমন ‘বসন্ত আওলরে! মধুকর গুনগুন,/ অমুয়া মঞ্জরী কানন ছাওলরে/ মরমে বহই বসন্ত সমীরণ, মরমে ফুটই ফুল/ মরমকুঞ্জ’পর বোলই কুহুকুহু অহরহ কোকিলকুল…।’
বসন্ত বাতাসে পুলকিত ভাটিবাংলার কণ্ঠ শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন : ‘বসন্ত বাতাসে… সই গো/ বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…।’
আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’।
বসন্ত বা পহেলা ফাল্গুন উদযাপনের ইতিহাস
১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো বসন্তবরণ উৎসব উদযাপন করা হয়েছিল। পরের বছর ১৯৯২ সালে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে একে অন্যের মুখে আবির মেখে ও ছোট একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বসন্ত উৎসব করে।
আর ১৯৯৩ সালে পহেলা ফাল্গুনে ক্যাম্পাসে হোলি উৎসবের আয়োজন করা হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের কারণে এখন বাংলা ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন ও ভালোবাসা দিবস একই দিনে পালন করা হয়। বসন্তমিশ্রিত ভালোবাসার এমন দিনে পরস্পরের শুভেচ্ছায় সিক্ত হবে প্রিয়জন।
আগে চিঠি লেখার প্রচলন থাকলেও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে বসন্তের শুভেচ্ছা। করোনা মহামারির মধ্যেও আজ নানা আয়োজনে বসন্তকে বরণ করবে বাঙালি। বিনোদন পার্কসহ অনেক জায়গায় মিলবে বসন্তের ছোঁয়া।