দেশীয় তাঁত শিল্প ও শিল্পীকে এগিয়ে নিতে একজন ঢাবি শিক্ষার্থী এক অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে। গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনার বাইরেও নিজের আলাদা একটা পরিচয় ও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য উদ্যোগকে বেছে নিচ্ছে আমাদের শিক্ষিত সমাজ। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করেও তাই অনেকে বেছে নিচ্ছেন নিজের একটা আলাদা পরিচয়ের উদ্যোগ।
তাঁত শিল্প সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা
তাঁত হচ্ছে এক ধরণের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতো থেকে কাপড় বানানো যায়। তাঁত বিভন্ন রকমের হতে পারে। খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সাধারণত তাঁত নামক যন্ত্রটিতে সুতা কুণ্ডলী আকারে টানটান করে ঢুকিয়ে দেয়া থাকে। লম্বালম্বি সুতাগুলিকে “টানা” এবং আড়াআড়ি সুতাগুলিকে “পোড়েন” বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে নেয়া হয় এবং সেলাই করা হয়। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে।
বাংলা তাঁত যন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল – “শানা”, “দক্তি” ও “নরাজ”।
শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে।
শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তাঁর উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তাঁর নাম “মুঠ-কাঠ”। শানা ধরে রাখার এই দুখানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম “দক্তি”।
তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায় যে তাঁত শিল্প মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে এই বস্ত্র তৈরি করে আসছে মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং।
এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল।
পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে নির্মিত সামগ্রী বাঙালি সমাজে নন্দিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশা করা ১২ হাত মনিপুরী শাড়ি, নকশি ওড়না, মনোহারী ডিজাইনের শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয় হয়ে ওঠে।
বাংলা নিউজ ইনফো আজ সাক্ষাৎকার নিয়েছে এমনই একজন নারীর। যিনি তাঁত শিল্প ও শিল্পীকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগকে বেছে নিয়েছেন নিজের একটা আলাদা পরিচয় হিসেবে। পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা।
নাদিয়া আক্তার নীনা, গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “স্বাস্থ্য অর্থনীতি” বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি ঢাকার কল্যানপুরে থাকেন।
(১) উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তাটা কিভাবে আসলো? এই সম্পর্কিত পুরো গল্পটা জানতে চাই।
– সত্যি কথা বলতে উদ্যোক্তা হওয়ার কোন পরিকল্পনাই ছিল না। হঠাৎ করোনা মহামারীর জন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে পড়ে এমনকি টিউশন পর্যন্ত। তাই অনেকদিন বেকার ঘরে বসে থাকতে হল। তো বন্ধুরা মিলে চিন্তা করলাম ঘরে বসেই কিছু করা যায় কিনা।
এইভাবে ৬ বন্ধু মিলে বিভিন্ন পরিকল্পনা করা শুরু হল। কিন্তু পরিকল্পনা যতই সামনের দিকে এগোতে লাগল বন্ধুর সংখ্যা ততই কমতে লাগল। ৬ থেকে ৫, ৫ থেকে৪, ৪ থেকে ৩ এসে ঠেকল। হতাশ হয়েছিলাম একটু সময়ের জন্য কিন্তু পরে ভাবলাম শুরু যখন করেছি আর পিছু হটব না কিছুতেই!
এভাবে আমরা ৩ জন মিলে শুরু করি আমাদের “আকিঞ্চন”। অপর দুজন হলেন: সুমাইয়া ইসলাম ও মুশফিকা বিনতে লতিফ সুষমা। সুমাইয়া ও সুষমা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। আমাদের সবকিছু বেশ ভালো ভাবেই শুরু হয়েছিল কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল কিছুদিন পরেই।
আরও পড়ুনঃ ডিপার্টমেন্টে ৩য় স্থান অধিকার করেও চাকরি ছেড়ে একজন উদ্যোক্তা
শাড়ি কিনে বাসায় ফিরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। উঠতে হল হাসপাতালের দরজায়, পরে জানা গেল ২ টি অপারেশন করাতে হবে। বাঁচার আশায় কিছুদিন মাথায়ই ছিল না বিজনেস এর কথা। কিন্তু তবুও আমরা হাল ছাড়িনি। সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে ভালোই চলছে আমাদের “আকিঞ্চন”। আর কিছুদিন পর ২ মাসে পা দিতে যাবে কিন্তু এরই মধ্যে আমার বহু মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্।
(২) আপনার শিক্ষাজীবন ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবনের না বলা গল্প জানতে চায়
– আমি খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বড় হয়েছি মফস্বলে, পরবর্তীতে ঢাকায় আসা। যাইহোক ছোটবেলায় খুব আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখে বড় হওয়া হয়ে ওঠেনি আমার, এখনও তেমনটাই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন হঠাৎ করেই হয়েছিল আর আল্লাহ্ সে স্বপ্ন পূরণও করেছেন।
আর পরিবার বলতে আব্বু আম্মু আর আমরা তিন বোন। ছোটবেলায় আব্বুর কাছে গল্প শুনে বড় হয়েছি আর আম্মুকে ভীষণ ভয় পেতাম। কিন্তু বড় হওয়ার পর আম্মু বন্ধুর মতোই হয়ে গেছে আর পরিবারে চারজন মেয়ে মানুষ থাকায় আব্বু একটু কোনঠাসা, হা হা হা।
আরও একটা ঘটনা যেটা আমি উল্লেখ করতে চাই সেটা হল, ছোটবেলায় আমি অনেক বুলির স্বীকার হয়েছি। যেটা আমাকে মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে জীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় পার করে দিয়েছি। যাইহোক সেইসব ঘটনার জন্যই হয়তো মানসিকভাবে আরো শক্তি পেয়েছি। পুরোনো দিনগুলোর সাথে এখন নিজেকে তুলনা করতে ভালোই লাগে।
(৩) আপনি কি কি পণ্য নিয়ে বিজনেস করেন আর কিভাবে তার বিস্তারিত বলুন-
– আমরা মূলত দেশীয় পণ্য ও তাঁত শিল্প নিয়ে আমাদের পথচলা শুরু করেছি এবং দেশীয় শাড়িকেই প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে পরবর্তীতে দেশীয় কাপড়ে কূর্তি, পাঞ্জাবি এবং অন্যান্য বস্ত্রাদি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো এদেশের যেসব তাঁত শিল্পীরা আছেন বা যারা আমাদের এই দেশীয় পোশাকগুলো তৈরি করছেন তাদের তুলে ধরা।
এই কাজ যাতে আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে না যায় সেই চেষ্টা করছি আমরা। শাড়িগুলো আমরা ঢাকার নিকটবর্তী বিভিন্ন হাট থেকে আনছি এখন। প্রায়ই তাই বাইরে বের হওয়া লাগছে। তবে আমরা চাচ্ছি ক্রেতা যেনো নিরাপদে ঘরে থেকেই শপিং করতে পারে।
(৪) বিজনেস থেকে পরিবার থেকে কোনো উৎসাহ অথবা বাঁধা পান কি?
– পরিবারই তো আমাদেরকে সাপোর্ট করছে শুরু থেকে। আমাদের মায়েরা প্রতিনিয়ত আমাদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখছেন। যাতে কাজ করে আরো বেশি অসুস্থ না হয়ে যাই। সেল বাড়ানোর নানা রকম আইডিয়া দিচ্ছেন। নিজেদের অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারতো যার অনেকটা থেকেই এই মায়েরা আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন আগেই।
তাই ভুলের পরিমাণ ও কম। তাছাড়া ছোট ভাই বোনেরাও অনেক সময় অনেক কাজে সাহায্য করে। খুব ছোট কাজ হলেও একজন উদ্যোক্তার সারাদিনের ক্লান্তির পর ওটুকুই সেরা শান্তি এবং বিশ্রাম। তাই বলবো পরিবারের সম্পূর্ণ সাপোর্ট পাচ্ছি আমরা।
(৫) এটা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
– আকিঞ্চনকে আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা অনেক দূর পর্যন্ত। আমরা চাই আকিঞ্চন এদেশের তাতী সম্প্রদায়কে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাক। যেখানে শুধু তাঁতীর কাপড়ের দামই থাকবেনা। সেখানে তাতীও তার ন্যায্য মূল্য পেয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে বেচে থাকতে পারেন। তাঁত এর দেশের শিল্পের সাথে, তার শিল্পীকে বিশ্বদরবারে আমরা একদিন তুলে ধরতে চাই। আকিঞ্চনে তখন যেনো আমাদের চেয়ে গ্রাহকের এবং তার চেয়ে বেশি তাতীর বিশ্বাস থাকে।
(৬) যারা নতুন উদ্যোক্তা হতে চায় বা নতুন কিছু নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের উদ্দশ্যে কিছু বলুন।
– আকিঞ্চন নিজেই একটি নতুন উদ্যোগের নাম। তবে মাস দুয়েক কাজ করে নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলবো, বসে থাকবেন না। যখন আপনি উঠে দাঁড়াবেন তখন আপনার আশে পাশে অনেককে নিয়ে আপনি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন। আমাদের হাতের আশে পাশেই এমন অনেক জিনিস আছে যা আমরা নিজেরা ভালো তৈরি করতে পারি।
আমরা জানি আমাদের আশেপাশে কোথায় সে জিনিস ভালো তৈরি হয়। তাই যা হাতের কাছে আছে, তাই নিয়েই একটা সুন্দর চিন্তা ভাবনা করবেন। আর আপনার সেই চিন্তা ভাবনাটা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করবেন। আর ধৈর্য্য ধরে কাজ করে যেতে হবে প্রতিনিয়ত। সফলতা তাহলে আসবেই।
তবে কাজ করতে করতে অসুস্থ হবেন না। মানসিক এবং শারিরীক দুই স্বাস্থ্যেরই যত্ন করুন। কারণ আপনার সুস্থতা এবং চিন্তা ভাবনা আপনার সাথে আরো অনেককেই তখন প্রভাবিত করবে।
বাংলা নিউজ ইনফো পত্রিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদেরকে এভাবে উৎসাহ দিয়ে পাশে থাকার জন্য।
বিশেষ ঘোষণাঃ
আপনার লেখা ছোটগল্প, জীবনের না বলা গল্প অথবা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শেয়ার করুন সবার সাথে। পত্রিকায় প্রকাশের জন্য যোগাযোগ করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেঃ
https://www.facebook.com/banglanewsinfo.official