রোদেলা যেন বহুকাল অপেক্ষা করে আছে তার সেই প্রিয় চোখজোড়া দেখার জন্য। হঠাৎই সে মধুমঞ্জরী ফুলের ঘ্রাণ পেলো পাঁচ বছর পর, এবং এক রকম আচ্ছন্নতা ভর করলো।
প্রায় পাঁচ বছর আগে এমন পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে শাহরিয়ার আর রোদেলা হঠাৎই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ার শেষ করে ইন্টার্নি করছিলো রোদেলা ঢাকা মেডিকেলে। শাহরিয়ার তখন সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালের ওয়ার্ডে, না হয় অন্য কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে মানব সেবা করে বেড়াতো আর নিজের এলাকা মানে ময়মনসিংহের সরিষাবাড়ি উপজেলার চাপারকোনা হাটে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় খোলার জন্য টাকা জোগাড় করতে ব্যাস্ত।
সে ডাক্তার হয়ে জনগণের সেবা করতে চেয়েছিলো কারন চিকিৎসার অভাবে ছোটবেলায় শাহরিয়ারের মা মারা যান। তাই বিসিএস না দিয়ে সে এলাকার মানুষের সেবা দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো।
এমন একটা নিবেদিত প্রাণকে ভালো না বেসে পারা যায়না তাই রোদেলা শাহরিয়ারের প্রতি একটা প্রবল টান অনুভব করতো। রোদেলার বাবা এর মাঝে রোদেলার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন বাইরে এম এমসি করা এক বিদেশ ফেরত ডাক্তারের সাথে। বড়লোকের ডাক্তার মেয়ের পাত্র তো তেমনই হওয়া চাই। কিন্তু রোদেলা কোনভাবেই শাহরিয়ারকে হারাতে রাজি নয়, তাই সেদিন কাউকে না বলে রোদেলা শাহরিয়ারের হাত ধরে সোজা চলে গেলো সরিষাবাড়ি।
কয়জন বন্ধু সেদিন ওদেরকে খুব হেল্প করেছিলো। ওরা বিকেল নাগাদ বিয়ের কাজ সেরে সন্ধ্যার পর সব বন্ধুরা আড্ডা দিলো খুব, খাওয়াদাওয়ার পর রাতে ওদের বাসর ঘরে রেখে বন্ধুরা চলে গেলো পাশের ঘরে। শাহরিয়ারের বাসরঘর হচ্ছে ওর বড় বোনের বাড়িতে, শায়লা খুবই আন্তরিক, রোদেলার খুবই পছন্দ হলো এই ছোট পরিবারকে, শাহরিয়ারের দুলাভাই অমাইক মানুষ, ব্যাবসায়ী। একটা মেয়ে আছে শায়লার।
সবাই বিদায় নেয়ার পর শাহরিয়ার বিয়ের পাঞ্জাবি ছেড়ে টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়েছে, একটু একটু ঠান্ডা আছে কারন মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হয় যেহেতু গ্রামীণ এলাকা।
হঠাৎ ই শাহরিয়ারের কি মনে হতে সে উঠে যেতে চাইলো, রোদেলা জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছো?
– যাচ্ছি মাধবীলতা ফুল আনতে। জানো রোদেলা যদি কেউ ফুলের ঘ্রানে মাতাল হয় তাহলে সেটা মাধবীলতা, অবশ্য ফুল টার আসল নাম মধুমঞ্জরী, তবে গ্রামের লোকজন মাধবীলতা নামেই চেনে।
আমি এক দৌড়ে গিয়ে বড় ঝোপটা থেকে মাধবীলতা ফুল নিয়ে চলে আসবো তোমার কাছে। আমারাতো বাসরঘর সাজানোর সুযোগ পেলামনা, ঘুমানোর আগে মাতালকরা ঘ্রানটা তোমাকে অনুভব করাতে চাই। শুধু আর পাঁচ টা মিনিট অপেক্ষা করো প্লিজ।
সারাদিনের জার্নি, টেনশনে রোদেলা অপেক্ষা করে করে কখন ঘুমিয়ে গেলো আর টেরও পেলোনা। এদিকে দ্বিপ্রহর পার হয়ে রাত শেষ হতে চললো তবু কেন যেন শাহরিয়ার ঘরে এলোনা। খুব ভোরে জানালা গলে ভোরের প্রথম আলো ঘরে ঢুকতেই রোদেলা ঘুম ভেঙে গেলো, তখনও ঘর ফাঁকা, শাহরিয়ার আসেনি। রোদেলার হৃদয়ের কাঁপুনি যেন হঠাৎই বেড়ে গেলো অজানা ভয়ে।
ঘন্টা দুই পর শাহরিয়ারের বন্ধুরা শাহরিয়ারের নিথর দেহটা এনে উঠানে রাখলো, রোদেলা আর শইতে না পেরে জ্ঞান হারালো। যখন ওর সংজ্ঞা এলো তার চোখে পড়লো শাহরিয়ারের ট্রাউজারের পকেট থেকে এক পলিথিন মধুমঞ্জরী ফুল উঁকি দিচ্ছে। কোন কিছু না বুঝে সে পলিথিনটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরতেই মাতাল করা ঘ্রান যেন তার সমস্ত অন্তর আত্মায় ঢুকে গেলো। এরপর আর কিছু মনে নেই রোদেলার।
দু বছর পর সে জানতে পেরেছে সেদিনের পর থেকে সে শুধু সারাক্ষণ মধুমঞ্জরীর ঘ্রাণ পেতো, রোদেলার বাবা দেশে অনেক বড় বড় মানসিক ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন তার ছোট খালার কাছে পাঠায় এবং দু বছর চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়।
দেশের কারো কোন ফোন নাম্বার তার জানা ছিলোনা তাই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। সে শুধু জানতো তার শাহরিয়ার আর এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয়। তারপর তিনবছর সে আবারো ডাক্তারি পড়াশোনা করে পুরো ডক্টর হয়ে দেশে আসে।
শাহরিয়ারের বোনের বাড়ি খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সেদিন শাহরিয়ারকে বিষাক্ত সাপে কেটেছিলো। যেহেতু গ্রামের বাড়ি এত রাতে কেউ দেখেনি ওকে, তাই বিষ খুব দ্রুত ছড়িয়ে তার ব্রেইন ড্যামেজ করে দেয়ায় শাহরিয়ার মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।
আরো একটা তথ্য রোদেলা জানতে পারে, সন্ধ্যানী চক্ষু হাসপাতালে নাকি শাহরিয়ার তার চোখ দান করার পেপারস রেডি করে রেখেছিলো অনেক আগে থেকেই। শাহরিয়ারের ডাক্তার বন্ধুরা যারা ওর বিয়েতে সেদিন ছিলো তারা বন্ধুর শেষ ইচ্ছেটা পূরন করে এবং সেদিনই তারা শাহরিয়ারের দেহের সাথে রোদেলা কেও ঢাকায় নিয়ে আসে।
বৈশাখের প্রথম প্রহরে শাহরিয়ার আর রোদেলা কলা ভাবনের যে বকুল গাছটার নিচে বসতো সেখানেই আজ রোদেলা এসেছে এবং যে চোখ তার জনম জনমের পরিচিত সেটা একটা সাত বছরের ছেলে বাচ্চার, সেই বাচ্চাটি তার মায়ের সাথে বৈশাখে ঘুরতে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।
বাচ্চাটির মায়ের সাথে কথা বলে রোদেলা জানতে পারলো বাচ্চাটির চোখ দুটো একটা দুর্ঘটনায় দৃষ্টিহীন হয়েগেছিলো, পাঁচ বছর আগে সন্ধানী চক্ষু হাসপাতাল থেকে একজন তার বাচ্চাকে চোখ দান করায় বাচ্চাটি এখন তার দৃষ্টি ফেরত পেয়েছে।
রোদেলা কিছু বলতে পারলোনা, সাত বছরের বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদল রোদেলা। চলে যাওয়ার সময় দূর থেকে তাকিয়ে রইলো বাচ্চাটি অপলক দৃষ্টিতে রোদেলার অসহায় মুখের দিকে। রোদেলার মনে হলো শাহরিয়ারের চোখদুটো যেন ওকে বলছে, আমি আছিতো, আমার দৃষ্টি বেঁচে রবে শুধু তোমারই অপেক্ষায়। ভালো থেকো রোদেলা, খুব ভালো থেকো।
রিবা সুলতানা যুথী
প্রভাষক (অর্থনীতি), লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ঢাকা।
এমফিল (M.Phil) গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।