পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় শুরুতেই নাঈম উদ্দিন আহমেদকে আহবায়ক করে সময়ের চাহিদায় গড়ে উঠেছিল ছাত্রলীগ। চাহিদাটি ছিল দেশের স্বার্থে আদর্শিক ছাত্রনেতা তৈরি করা।
অভিজাতদের হাত থেকে রাজনীতির নাটাই সাধারনের কাতারে আনতে এই ধরনের একটি সংগঠন খুব জরুরী ছিল। স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত সংগঠনটি সেই আদর্শিক ছাত্রনেতা তৈরি করে সময়ের চাহিদা ভালভাবেই পূরণ করতে পেরেছিলেন।
ছাত্রলীগের হোঁচট খাওয়া শুরু হয় স্বাধীনতার অল্প কিছু আগ থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে, আওয়ামীলীগে শেখ মুজিবুর রহমানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর।
দলীয় আধিপত্য ধরে রাখতে এই সময় থেকে আদর্শিক ছাত্রনেতৃত্বের পরিবর্তে পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেন তিনি। ছাত্রলীগের বর্তমান যে কমিটি তা পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাত্রলীগে আদর্শিক ও ক্যারিশম্যাটিক ছাত্রনেতা বনাম পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতার দ্বন্দ্বে শেখ মুজিবুর রহমান বেছে নিয়েছিলেন পরিবারকে।
‘আমরা আইনের শাসন চাই না, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন চাই’ _ ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ মনি। নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে যান শেখ মনি। অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন সিরাজুল আলম খানদের মতন আদর্শিক ছাত্রনেতারা।
এরপর শেখ হাসিনাও যখনি সুযোগ পেয়েছেন, তিনি আদর্শিক নেতৃত্বের বদলে পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ১৯৮১ তে দেশে ফেরার পরে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতাদের বিরোধিতার মুখে পরেন তিনি।
এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাত্র সংসদ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সব নির্বাচনেই হেরে যাওয়া ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন আওয়ামীলীগে রক্তের উত্তরাধিকার চাই। এর প্রেক্ষিতেই প্রাথমিকভাবে উৎরে যান শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুনঃ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের ৩৯৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি
সেই থেকে তিনিও রক্তের উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে আনতে সচেষ্ট হন। বাবার মতন পার্টিতে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পুর্ব পর্যন্ত ছাত্রলীগে আদর্শিক নেতাই বানিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে কখনও স্বস্তিতে ছিলেন না তিনি।
পার্টিতে অবস্থান সুদৃঢ় করেই পর্যায়ক্রমে ছাত্রলীগে পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নিয়ে আসেন ইকবালুর রহিমকে, যার বাবা এম আব্দুর রহিম ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর এবং আওয়ামীলীগ দলীয় এমপি।
এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি দলের সভানেত্রী হিসেবে এক্সট্রা প্রিভিলেজ দিয়েছেন আওয়ামী লিগাসি বহন করে এমন পরিবারের ছেলেদের।
মাহবুবুল হক শাকিল, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কিংবা সাইফুজ্জামান শিখর সহ এরকম আরো অনেক নাম এই তালিকায় যুক্ত করা যাবে।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ‘৯৬ তে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগে এই ব্লাড থিওরি থেকে আপাত সরে আসেন। এই সুযোগে বাহাদুর ব্যাপারী, অজয় কর খোকন, লিয়াকত শিকদার, মারুফা আক্তার পপিরা নেতৃত্বে চলে আসেন।
ক্ষমতাসীন সময়ে এবং পরবর্তীতে দলে নিরংকুশ ক্ষমতা থাকার পরও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে পূর্বের মতন অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি।
উপরন্তু যেকোন ভাবেই হোক লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পরে শেখ হাসিনার এই পরিবারতান্ত্রিক ছাত্রনেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন।
যার ফলে, রিপন-রোটন, সোহাগ-নাজমুল কিংবা সোহাগ-জাকিরেরা আওয়ামী বেজড পরিবার না হওয়ার পরও ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আহরণ করতে পেরেছিলেন।
খোদ ছাত্রলীগেই শেখ হাসিনার ছাত্রলীগ ও সিন্ডেকেট ছাত্রলীগ বলে দুইটা আলদা টার্ম চালু আছে। এই আদর্শিক ছাত্রনেতার চেয়ে ব্লাড লিগাসি বহন করে এমন ছাত্রনেতারাই শেখ হাসিনার জন্য অধিক নিরাপদ বিবেচনায় শেখ হাসিনা আবারো তার ‘ব্লাড লাইন লিগাসি’ থিউরিতেই ফিরে গেছেন। ছাত্রলীগের বর্তমান ও ভেংগে যাওয়া কমিটি ঘাটলেও দেখা যায় এইখানে মুখ্য বিষয় পারিবারিক বিশ্বস্ততা।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, একটা দল যত পুরনো হয়, দলটার প্রাথমিক গঠনগত সৌকর্য কিংবা বিকারগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে। গণতান্ত্রিক দলগুলো যেসব ছোট-বড় ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়, ধীরে ধীরে তা সারিয়ে নেয়ার একটা প্রবণতা তাদের মাঝে থাকে। স্বৈরাচারী কায়দায় গঠিত দলে অবশ্য এসবের বালাই নেই।
পরিবারতান্ত্রিকতা, ব্লাড লিগ্যাসি এ শব্দগুলো গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটের বিপরীত। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রাচীন হতে পারে, কিন্তু পরিবারতান্ত্রিকতা, ব্লাড লিগ্যাসি ধরে রাখার যে প্রবণতা সেটা আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক আইডেন্টিটিকে যথেষ্ট পরিমান প্রশ্নের সমুখীন করে। উপরন্ত ব্লাড লিগ্যাসি উপর ভর তরে আসা নেতাদের এফিশিয়েন্সি নিয়েও যথেষ্ট পরিমাণ প্রশ্ন আছে।
রাজার বড় ছেলে রাজা- প্রাচীন ভারতে এই রাজনৈতিক তত্ত্ব থাকায় এই ভূমি বার বার বিদেশীদের দ্বারা শোষিত হয়েছে। তারকার ছেলে যেমন তারকা হয় না, খেলোয়াড়ের ছেলে যেমন খেলোয়াড় হয় না, তেমনি নেতার ছেলেও নেতা হয় না।
কিন্তু ব্লাড লিগাসির মতন পুওর মেথড দলের মূল কাঠামোতে অযোগ্য লোকের প্রবেশ সহজ করে দলকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। অযোগ্য লোকের পদায়ন শুধুমাত্র যে দলকে অথর্ব করে তা নয়, একই সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে উন্থানের পথটা রুদ্ধ হয়ে অনেক যোগ্য আর প্রতিভাবান লোককে দূরে ঠেলে দেয়। সেটার মাশুল যে শুধু দল দেয় তা নয়, দেশকেও দিতে হয়।
ব্লাড লিগাসিতে আসা ছাত্রলীগ নেতারা আওয়ামী লীগকে, দেশকে কতটা নিচে নামাচ্ছে সেটা গত কয়েক বছর থেকেই আমরা দেখছি। সময়ের সাথে সাথে এরা যে আরো নিচেই নামবে সেটা মনে হয় জ্যোতিষী না হয়েও বলে দেওয়া যায়।
লেখকঃ সরদার আমিরুল ইসলাম সাগর
সাবেক মুক্তিযুদ্ধ গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটি।
বিশেষ ঘোষণা:
আপনার লেখা কলাম, ছোটগল্প, জীবনের না বলা গল্প অথবা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শেয়ার করুন সবার সাথে। পত্রিকায় প্রকাশের জন্য যোগাযোগ করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেঃ
https://www.facebook.com/banglanewsinfo.official